নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের রহস্য: তিনি কি সত্যিই বেঁচে ছিলেন?

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং অগ্রগামী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ভারতকে স্বাধীন করার জন্য তার সংগ্রামী মনোভাব প্রভাব ফেলেছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন, তিনি স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন। ১৯৪৩ সালে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ অৎসু বা ওঘঅ) গঠন করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা চালান। তার প্রেরণামূলক স্লোগান যেমন “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো,” “জয় হিন্দ” এবং “দিল্লী চলো” ভারতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
তাঁর মৃত্যু নিয়ে আজও রহস্য ঘনীভূত। সরকারি নথি অনুযায়ী, সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট একটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। জানা যায়, তিনি মাঞ্চুরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় বিমানে নিখোঁজ হয়ে যান। ২৩ আগস্ট, জাপানের একটি সংস্থা জানায় যে সুভাষ চন্দ্র বসুর বিমান তাইওয়ানে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তিনি মারা গেছেন। তবে কিছুদিন পর জাপান সরকার জানায় যে ওই দিন তাইওয়ানে কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনার পর থেকেই তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
গুজব এবং তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে যে নেতাজী হয়তো গুমনামি বাবা নামের একজন সন্ন্যাসী হিসেবে উত্তর প্রদেশে বাস করছিলেন, অথবা তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। নেতাজীর মৃত্যুর আসল ঘটনা এখনও ভারতের অন্যতম বড় রহস্য হয়ে আছে।
কী ঘটেছিলো সেদিন ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের পর, পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানি সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে তলানিতে পৌঁছেছিল। সেই পরিস্থিতিতে, সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে সাইগন পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে এগোনোর জন্য কোনো জাপানি বিমান পাওয়া যাচ্ছিল না। বহু চেষ্টা করার পর, তিনি একটি জাপানি বোমারু বিমানে সিট পেয়ে যান।
বিমানঘাঁটিতে তাকে বিদায় জানাতে আসা আজাদ হিন্দ ফৌজের সহকর্মীদের সঙ্গে করমর্দন করে, “জয় হিন্দ” বলে অভিবাদন জানিয়ে কিছুটা লাফিয়ে বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিলেন তিনি। বিমানে ওঠার পর, তাঁর এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানও অন্যদের সঙ্গে ‘জয় হিন্দ’ বলে বিদায় জানিয়ে বিমানে উঠে যান।
‘লেইড টু রেস্ট’ নামক বইয়ের লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক আশিস রায় বলেন, “ওই বিমানে ক্রুসহ ১৪ জন ছিলেন। পাইলটের ঠিক পিছনে বসেছিলেন নেতাজী। তাঁর সামনে পেট্রোলের বড় বড় জেরিক্যান রাখা ছিল। নেতাজীর পিছনে ছিলেন কর্নেল হাবিবুর রহমান।”
তিনি আরও বলেন, “বিমানে ওঠার পর, জাপানিরা নেতাজীকে সহ—পাইলটের আসনে বসার অনুরোধ করেন, তবে তিনি বিনম্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। আসলে, সহ—পাইলটের আসনটি তার মতো লম্বা মানুষের জন্য খুব ছোট ছিল।”
আশিস রায় জানান, “পাইলট এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল শীদে ছাড়া বাকি সকলেই বিমানের মেঝেতে বসেছিলেন। নেতাজীকে একটি ছোট কুশন দেওয়া হয়েছিল, তবে কারও কাছেই সীট বেল্ট ছিল না।”
বিমানটি খুব ঠাণ্ডা ছিল, কারণ সেই সময় যুদ্ধবিমানগুলিতে এয়ার কন্ডিশনার থাকত না। প্রত্যেক হাজার মিটার উঠলে, বিমানের তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি করে কমে যেত। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে, সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে জ্যাকেটটি চেয়ে নেন।
বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে, বোমারু বিমানটি জমি ছেড়ে আকাশে উড়ে যায়।
অন্তর্ধান রহস্য
১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইপেইতে একটি বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর পরেই নেতাজীর মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়া নিয়ে একাধিক রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। সত্য উদঘাটনের জন্য একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে শাহনওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন এবং মুখার্জি কমিশন উল্লেখযোগ্য।
শাহনওয়াজ এবং খোসলা কমিশন সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনার পর নেতাজী মারা গিয়েছিলেন বলে দাবি করে। তবে, মুখার্জি কমিশনের মতে, নেতাজী দুর্ঘটনার পরও জীবিত ছিলেন। এমনকি নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে বসু পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বিভাজন রয়েছে। তবে, ভারতীয় সরকার নেতাজীর মৃত্যুকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। ১৯৪৫ সালে তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সেই তথ্য সঠিক কি না তা যাচাই করার জন্য গত ছয় দশকে একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
এই বিষয়ে ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য সুখেন্দু শেখর রায়ের প্রশ্ন, যদি প্রথম দুটি কমিশনের মতামত সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে কেন তৃতীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল এবং কেন সেই কমিশনের প্রতিবেদন কোনো কারণ ছাড়াই বাতিল করা হলো? তিনি বলছেন, “পঞ্চাশের দশকে শাহনওয়াজ কমিশন জানিয়েছিল, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে। সেই প্রতিবেদন সরকার মেনে নিয়েছিল। তারপর আবার ৭০—এর দশকে খোসলা কমিশন গঠন করা হয়, এর মানে কি সরকারের মধ্যে শাহনওয়াজ কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে সন্দেহ ছিল? আর এই দুটি কমিশন যখন একই কথা জানিয়েছিল, তখন মুখার্জি কমিশন কেন তৈরি হল?”
বিচারপতি মনোজ মুখার্জীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তারা তাইহোকু বিমানবন্দরের সব নথি খতিয়ে দেখে মতামত দেয় যে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট সেখানে কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। এই প্রতিবেদনটি সরকার কোনো কারণ ছাড়াই বাতিল করে দেয়। সুতরাং, ভারত সরকার অফিসিয়ালি সেদিন দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছে, এমন তথ্যই সমর্থন করে।
গোপন নথি ও অমীমাংসিত রহস্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে নেতাজীর অন্তর্ধান নিয়ে ২০টি গোপন ফাইল রয়েছে বলে জানা যায়। তবে এই নথিগুলি প্রকাশ করা হলে ভারতের কিছু বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সচিবালয় এক সংসদ সদস্যকে জানায়, এসব নথি প্রকাশ করা হবে না এবং এ নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলাও নিষিদ্ধ।
আজও, নেতাজীর আসল মৃত্যু কিভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তাঁর অন্তর্ধান রহস্য আজও ভারতের ইতিহাসের এক বড় রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।