বাংলাদেশের ‘মাসুদ রানা’: আসল গুপ্তচর নাকি কাল্পনিক চরিত্র?

বাংলাদেশের জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুজব প্রচলিত যে, এই চরিত্রের পেছনে আসলে একজন বাস্তব জীবনের গুপ্তচরের গল্প রয়েছে। কিন্তু এই ধারণা আসলে কতটা সত্য? সত্যি কি মাসুদ রানা বাস্তব জীবনের কোনো গুপ্তচর থেকে অনুপ্রাণিত?
মাসুদ রানা: এক অনন্য সৃষ্টি
১৯৬০—এর দশকের মাঝামাঝি থেকে আজ পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং তা বেড়েই চলেছে। এই চরিত্রটি তৈরি করেছেন বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন । তিনি বাংলাদেশের প্রথম স্পাই থ্রিলার সিরিজের জন্ম দিয়েছেন, যা পাঠকদের কাছে আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। রহস্য ও সাহসিকতার মিশেলে তৈরি এই চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করে।
মাসুদ রানা চরিত্রের নামকরণ সম্পর্কে কাজী আনোয়ার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেছিলেন। এখানে দুটি বাস্তব মানুষের নামের মিল ছিল—গীতিকার ‘মাসুদ করিম’ এবং ইতিহাসের বিখ্যাত মেবারের রাজপুত রানা প্রতাপ সিংহ। এই দুই নাম মিলিয়েই তৈরি হলো ‘মাসুদ রানা’।
তবে মাসুদ রানা চরিত্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও এজেন্সির সম্পূর্ণটাই লেখকের কল্পনার ফসল। কাজী আনোয়ার হোসেন স্পষ্টভাবে বলেছেন, “মাসুদ রানা সিরিজ ও প্রতিটি চরিত্র আমার সৃষ্টি।” তাই মাসুদ রানা কোনো বাস্তব ব্যক্তি নয়—এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
কাজী আনোয়ার হোসেন: সৃষ্টির আড়ালে মানুষ

কাজী আনোয়ার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালে, প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন—এর ঘরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং একটি সময় রেডিওতে গান গাইতেন। তাঁর পরিবারের অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তাঁকে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।
পরবর্তীতে তিনি বাবার সমর্থনে ‘সেবা প্রকাশনী’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশে বিশ্ব সাহিত্যের জনপ্রিয় অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালে প্রথম মাসুদ রানা সিরিজের বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশিত হয় এবং এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়। এরপর থেকে প্রায় সাড়ে চারশোরও বেশি বই এই সিরিজের অধীনে প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা কাহিনির ধারা পাল্টে দেয়।
মাসুদ রানা সিরিজের জনপ্রিয়তা
মাসুদ রানা সিরিজের বেশ কিছু বই আজও পাঠকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো:
— ধ্বংস পাহাড়
— ভরতনাট্যম
— স্বর্ণমৃগ
— মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
— দুর্গম দুর্গ
— শত্রু ভয়ঙ্কর
— রানা! সাবধান!!
প্রতিটি বইতে সাহসিকতা, রহস্য, এবং চ্যালেঞ্জের এক অভূতপূর্ব মিশেল দেখা যায়, যা পাঠকদের অবিরাম আকর্ষণ করে রেখেছে।
মাসুদ রানা: বাস্তবতা নাকি মিথ?
বিভিন্ন সময়ে অনেকেই মাসুদ রানা চরিত্রের পেছনে কোনো আসল গুপ্তচরের গল্প আছে বলে মনে করলেও, কাজী আনোয়ার হোসেনের নিজের কথা থেকেই স্পষ্ট যে, এই দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। ‘মাসুদ রানা’ কোনো বাস্তব ব্যক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি, বরং এটি লেখকের সৃজনশীল কল্পনার ফল।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র মাসুদ রানা শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক সৃষ্টি হলেও, এর জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব অবিস্মরণীয়। কাজী আনোয়ার হোসেনের অসাধারণ দক্ষতা এবং সাহসী কল্পনা বাংলার সাহিত্যে মাসুদ রানা সিরিজকে অমর করে তুলেছে।
তথ্যসূত্র :
১। কাজী আনোয়ার হোসেনের ভুবনে, শিবব্রত বর্মন ও রওশন জামিলের সাক্ষাৎকার, দৈনিক প্রথম আলো।
২। লেখকের মুখে মাসুদ রানা লেখার ইতিহাস, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
৩। মাসুদ রানা: সুপার স্পাই ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিকশন, দ্য ডেইলি স্টার।
৪। একজন কাজী আনোয়ার হোসেন ও অমর সৃষ্টি ‘মাসুদ রানা’, দ্য ডেইলি স্টার
৫। মাসুদ রানা সিরিজ ও প্রতিটি চরিত্র আমার সৃষ্টি: কাজী আনোয়ার হোসেন, দ্য ডেইলি স্টার
৬। VOA বাংলা